বাংলা ভাষা নিয়ে টানা হেঁচড়া কম হয়নি, হচ্ছেও না। এই তর্কের যেন মীমাংসা নাই। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান শুধু না আস্তিক নাস্তিক প্রায় সব বাঙালিরই মধ্যে মাতৃভাষা বাংলার হিন্দুয়ানিকরণ আর মুসলমানিকরণ নিয়ে কূট তর্ক চলছেই।
একবিংশ শতাব্দিতেও এমন বিতর্ক জুড়ে বসায় বুঝতে অসুবিধা হয় না এর মূলে সাম্প্রদায়িক তাড়না। ১৯০৩ সালে গিয়ারসন দেখান-বাংলা প্রাকৃত (মাগধী) ভাষার পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট। এর আগে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে কারোরই ধারণা ছিল না। উনিশ শতকের পণ্ডিতদের বিশ্বাস ছিল-সংস্কৃত ভাষা এই ভাষার মূলে।
১৮০০ সালে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ। সংস্কৃত পণ্ডিতরা বাংলা গদ্য নির্মাণে হাত দেন। বিশ্বাস অনুসারে তারা সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন। এই সময়েই প্রকাশিত রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থে সংস্কৃতর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফারসি থেকে ঋণ করা শব্দ ব্যবহার হতেও দেখা যায়। একই শতাব্দীতে প্রকাশিত আরও অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী লেখকের সাহিত্য সংস্কৃতবহুল ভাষায় ছিল না। সংস্কৃত শব্দবহুল ভাষায় অনেক মুসলমানও সাহিত্য চর্চা করেছেন। ফলে ঠিক কোনও সম্প্রদায়ের সবাইকেই একই কাতারে ফেলে বিচার করার উপায় নাই। তবে ইতিহাসে বাংলা বিরোধী সংস্কৃত পণ্ডিত যেমন মেলে, তেমনই যবন বিরোধীও।
তবে ঢাকার বাজারে ‘যবন’ বিরোধী পণ্ডিতদের বদলে প্রধান আক্রমণের বস্তু হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! অথচ রবীন্দ্রনাথরা সংস্কৃতপন্থিদের বিরোধী গোষ্ঠী ছিলেন-বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাথে ভাষা প্রসঙ্গে বিতর্কে জড়ান তারা।
উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত আর খাঁটি বাংলা শব্দের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সূচনায় সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুগত বাংলা আর স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত ভাষার পক্ষে দুই গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। বাংলাপন্থি গোষ্ঠীতে ছিলেন- দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও অন্যান্য।
এ নিয়ে দুপক্ষের বিপুল পরিমান পাল্টাপাল্টি লেখালেখি রয়েছে। প্রাসঙ্গিক একটি বাক্যেই পাঠক বুঝবেন রবীন্দ্রনাথদের অবস্থান-শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী তার ‘নূতন বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে লেখেন, “ইহারা (রবীন্দ্রনাথরা) ‘বিসমোল্লায় গলদ’ প্রভৃতি যে সকল বলাইতে ইচ্ছুক উহা একান্তই অশ্রদ্ধেয়। যদি কেহ লেখেন ‘যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বলিলেন প্রিয়ে তুমি যে কথা বলিতেছ উহার বিমোল্লায়ই গলদ’ তাহা হইলে প্রয়োগটি কি অতিশোভন হইবে?” তবে ভাষা প্রশ্নে ‘বাংলাপন্থি’ রবীন্দ্রনাথদের মুসলমান বিদ্বেষী হিসেবে সমালোচনা কেন?
চর্যাপদ উদ্ধারের পর বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক কেটেছে বাংলা ভাষার ইতিহাস অনুসন্ধানে। গ্রাম্যশব্দ-সংকলন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মুখ্য একটি কাজ বলে জানিয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ‘গ্রামশব্দ সঙ্কলন’ এ কাজে অবদানের জন্য মৌলবী রবীউদ্দীন আহমেদের দারুণ প্রশংসা করেন। আর রবীউদ্দীন তার ‘শব্দসংগ্রহ’ প্রবন্ধে জানান, হিন্দুবাসহীন এক গ্রাম থেকে তিনি শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন। এ কাজে তার বাবা মোল্লা আব্দুল বারী এবং মুন্সী আব্দুল কাদের নামে গ্রামের স্কুলের প্রধানশিক্ষকের সহায়তাও নেন তিনি। সুনীতিকুমারের উল্লেখিত প্রবন্ধে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে আমদানি করা সংস্কৃত অথবা বিদেশি শব্দের বদলে বাংলার গ্রামে গ্রামে কথ্যভাষায় ব্যবহৃত শব্দকেই মান ভাষায় প্রাধান্য দানই অভিপ্রায় তাদের। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না-কলকাতা কেন্দ্রিক সব কাজকে হিন্দুয়ানি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার চলতি কাণ্ডকারখানার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে।
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে-সংস্কৃত উৎসের শব্দই শুধু নয় যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ব্যবহৃত অনেক শব্দ বাতিলের চেষ্টাও চলছে। এমন কি পারস্য ঘুরে ফিরে আসা শব্দও। দক্ষিণ এশিয়ও মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহ ও খোদা দুটোই অতীত থেকে চালু। অধুনা খোদা বাতিলের খাতায় পড়েছে-সংস্কৃত উৎস থেকে সৃষ্ট ফারসি শব্দ খোদা ও নামাজ জাতীয় শব্দগুলো তারা বিতাড়িত করতে চান। খোদা শব্দের মূলে সংস্কৃত স্বধা, নামাজ শব্দের মূলে সংস্কৃত নমঃ/নমস এই কাণ্ডের কারণ। এদের সঙ্গে চিন্তাধারায় সাম্প্রতিককালের ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি উৎপাটনপন্থিদের চেতনা একই কাতারে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারায় তারা মুসলিম বাংলা গঠনে উত্তেজিত এখনও। ফলে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা ভাষা নির্মাণে উদ্যোগীদের কাছে রবীন্দ্রনাথরাই প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।
বাংলা ভাষার হাজার বছরের অভিযাত্রায় সংস্কৃত, ফারসি, আরবিসহ নানান ভাষার শব্দ ও রীতি আত্মীকরণ ঘটেছে। বাংলা ভাষার যতিচিহ্নর প্রায় পুরোটাই ইংরেজি ভাষা দেখে নেওয়া। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “বাঙালি মুসলমানের দুটি গোত্র বাঙলা-উর্দু বিতর্কে লিপ্ত থেকেছে কয়েক শতাব্দী, এবং ওই বিতর্ক এক সময় আন্দোলনে পরিণত হ’য়ে সৃষ্টি করেছে একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু সে-স্বাধীন দেশেও বাঙলা ভাষা সর্বোচ্চ অবস্থানে নেই-এটা সম্ভবত বাঙলা ভাষার বৃহত্তম-করুণতম ট্র্যাজেডি।”
উনিশ শতকেও বাংলায় শুধু বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের বাস ছিল না। অন্যান্যের মধ্যে উর্দু-ফারসি ভাষীরাও বাস করতেন। ১৯০২ সালে ‘কলিকাতা মুসলমান শিক্ষা সভায়’ ধর্মীয় চরিত্র ঠিক রাখার নামে শিক্ষার মাধ্যম উর্দু করার প্রস্তাব ওঠে। এ সময় উর্দু ভাষী আর বাংলা ভাষীদের মতবিরোধ ঘটে এবং মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষার দাবী ওঠে বলে ‘বাঙ্গালী মুসলমানের উৎপত্তি ও বাঙ্গালী জাতির বিকাশের ধারা’য় সৈয়দ আব্দুল হালিম লিখেছেন। তবে মুসলমানের লুপ্ত গৌরব উদ্ধারে নামা ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলমান শিক্ষা সমিতি’ ১৯০৩ সালে মুসলমানদের ইংরেজি ও বাংলা ভাষা শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না-ভাষা আন্দোলনের অর্ধ শতাব্দী আগেই এ ধারার শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির একাংশ মুসলমান বাংলা ভাষার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।
তাই ভাষা প্রসঙ্গে সবাইকে ‘মুসলমান’ এইভাবে শ্রেণিবদ্ধ করলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয় না, সমস্যা কোথায় বোঝাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। আশরাফ আর আতরাফ মুসলমানের ভাষা এক নয়। নানা ভাষাভাষীর আবাস এই বাংলায় বাঙালির চাইতে অন্যদের স্বার্থ তাড়িত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, ভাষাও তার মধ্যে পড়ে। হকিকত-ই-মুসলমান-ই-বাঙ্গালাহ-তে খোন্দকার ফজলে রাব্বী বাঙালি মুসলমান বিদেশি মুসলমানের বংশধর দাবী করেন। অথচ বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝানো হয় তাদের পূর্বপুরুষ আরব-পারস্য-তুরস্ক থেকে আগত নয়, তারা এই মাটির আদি সন্তানদের বংশধর মাত্র।
গৌরব করার মতো প্রাচীন সভ্যতা পারস্যে ইসলামের পতাকা হাতে আরব আগমনের পর সেদেশের ভাষা পরিস্থিতির ইতিহাস সবার জানা। ঐতিহাসিক নানা কারণেই প্রতিটি ভাষায় অন্য ভাষা থেকে রীতিনীতি, শব্দাবলি আত্মীকরণ হয়ে থাকে। কখন কীভাবে ভিন্ন ভাষার উপাদান মিশেছে সে ইতিহাস জানা যেতে পারে তবে জনসমাজে প্রচলিত হয়ে গেলে ভাষার অঙ্গই হয়ে যায়।
তবে ভিন দেশিরা যা আনেন সব যে রয়ে যায় তাও নয়। যে সময় হিন্দু লেখকরা বাংলাকে সংস্কৃত ঘেঁষা ভাষা বানাচ্ছেন বলে অভিযোগ, সেই সময় কতিপয় মুসলমান কীভাবে বাংলা লিখতেন তার একটি নমুনা ‘বাঙ্গালী মুসলমানের উৎপত্তি ও বাঙ্গালী জাতির বিকাশের ধারা’ গ্রন্থ থেকে তুলে দিচ্ছি:
‘মহাম্মদী আখবার’-এর ১৫ জুন, ১৮৭৭ এর সম্পাদকীয়র একাংশ- “ভাইগণ, রাশিয়া লালচ ও আদাওতের সববে রূমের পরে চড়াই করিয়াছে। কারণ এই য়ে, মক্কা, বায়তুল মোকাদ্দাস মদীনা ও কারবালা হাত করিয়া মুসলমানদের ইমানের হানি করে। তুর্কী মুসলমানেরা ইমানকে জান হইতে অধিক জানে, এই বিপদ টালিবার জন্য জোরু, লাড়কা, জানমাল শুদ্ধা খোদার রাহে দিতে আছে। হাজারও হাসপাতালে কতো কতো জখমি পড়িয়া আছে, হাজারও বেওয়া আওরত, অনাথ ও লাচার বসিয়া আছে। ঐ জখমিদের জন্য আর ঐ বেওয়াদের জন্য… তাহাদের খবর নিতে টাকা পাঠাও। দেখো সওয়াব সস্তায় বিলাইতেছে। কিনে লহ। বেহেস্ত অল্প পয়সায় পাওয়া যাইতেছে।” প্রশ্ন হচ্ছে এই ভাষা কোন গ্রামবাংলার মুসলমানের কথ্য ভাষা?
শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে বাঙালি মুসলমান হীনবীর্য হবার অজুহাত দেখিয়ে ‘কলিকাতা মুসলমান শিক্ষা সভায়’ উর্দুকে শিক্ষার ভাষার প্রস্তাব যে কারণে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরও বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ একই চিন্তার ফসল। নানা ভাবেই বাংলার উপর হামলা হয়ে আসছে আজ অব্দি-যার মূলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি।
এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উদগীরণে চলতি শত্রু হচ্ছে- সংস্কৃত ভাষার থেকে ঋণ-শব্দ। ঢাকা আর কলকাতা কেন্দ্রিকতা নিয়ে ঝনঝনানির মূলে আধুনিক ভাষা নির্মাণের তাগিদের চাইতে মুসলিম বাংলার খোয়াবই জ্বলজ্বলে।
‘বাঙলা ভাষা’ গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ জানন, উনিশ শতকে শুরু হয় ‘সুপরিকল্পিত-সচেতন বাঙলা গদ্যের’ এবং আঞ্চলিক ভাষা থেকে ‘প্রধান ভারতীয় ভাষা’ হয়ে উঠতে শুরু করে।… ইংরেজি, সংস্কৃত, ল্যাটিন ব্যাকরণে চোখ রেখে চলে নানান পরীক্ষা।
সৈয়দ আবদুল হালিম দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ জ্ঞাতসারে যত ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তার চেয়েও অনেক বেশি ফারসি ঋণশব্দ ঠাসা তার সাহিত্যে। সাম্প্রতিক কলকাতার বাংলা পত্রিকা উদ্ধৃত করে তিনি দেখান-পশ্চিমবঙ্গে ভাষায় ব্যাপকভাবেই ফারসি ঋণশব্দ এখনও ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ভাষা নিয়ে রেষারেষিতে হিন্দু–মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্ব খাটে না। কিন্তু কলকাতা কেন্দ্রিক সব কর্মকাণ্ডকেই হিন্দুয়ানি বলে দেখানোর চেষ্টাই বা কেন, বিরোধই বা কোথায়?
সংস্কৃত পণ্ডিতদের এই ভাষা নিয়ে অনেক ছুৎমার্গ এর কথা সবার জানা। অথচ সংস্কৃত সাহিত্যেও অন্য ভাষার মিশ্রণ রয়েছে-‘মোদের গরব মোদের আশা’ গ্রন্থে শিশিরকুমার দাশ বলেছেন, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে সংস্কৃত, শৌরসেনী, মাগধী প্রাকৃত ও প্রাকৃত (মহারাষ্ট্রী) ভাষার ব্যবহার রয়েছে।
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন বেদেও অন্য ভাষার ঋণশব্দ রয়েছে। গোলাম মুরশিদ ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’-তে জানান, পূজোর মন্ত্রে আরবি-ফারসি ঋণশব্দের অনুপ্রবেশের কথা। কী প্রাচীন কী আধুনিক কোনও ভাষাই নিরেট একা একা চলে না- বাংলা হোক আর আরবি হোক। এই প্রক্রিয়া আধুনিককালের ব্যাপার শুধু নয়, প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।
আরবও বিচ্ছিন্ন কোনও অঞ্চল ছিল না। প্রতিবেশী সিরিয়া, পারস্য, অ্যাবেসিনিয়ার সাথে তার যোগাযোগ ছিল। অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আদান প্রদান হয়েছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক নানান ধ্যান-ধারণা। প্রথম যুগের মুসলমান আলেমরাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন কোরানে ইহুদি, খ্রিস্টান আর ইরানি সূত্রের ভাষা-পরিভাষার ঋণ।
আর্থার জেফারি ১৯৩৭ সালে কায়রোতে বসে প্রকাশ করেন The Foreign Vocabulary of the Qur’ān. গ্রন্থটি অনলাইনে পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, নবীজি আরবি ছাড়াও অন্য ভাষাভাষীর সংস্পর্শে এসেছেন, এমন কি আরবি ছাড়াও অন্য ভাষা বোঝা ও বলায় পারদর্শীও ছিলেন। আদি মুসলিম আলেমদের উদ্ধৃতিসহ তিনি অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছেন কোরানে ব্যবহৃত কোন শব্দটি কোথা থেকে এসেছে।
দক্ষিণ আর উত্তর আরবের বাচনের তফাতের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। তার উল্লেখিত অনেক ভাষাই সাধারণ পাঠকের অচেনা হতে পারে। অন্যান্য ভাষার মধ্যে গ্রিক, আরমাইক, সিরিয়াক, ইথিয়পিক, পাহলভি, পারসিক, পালি, তামিল, মালায়লাম ভাষার সাথে সাথে সংস্কৃত ভাষার উল্লেখও রয়েছে বইটিতে।
সংস্কৃত ভাষার অথর্বণ, অপ, আভা, কর্পুর, কার, কলম, কীষ্ম, গঞ্জ, গঞ্জবর, দিলার, নমরা, পরণু, পীখ, মুষক, রোচ, রোম, রোদ, বিলাঙ্গ, বৃন্দা, ভৃঙ্গবর, খবিশ, খর, সূক্ষ্ম ও সুমন এই শব্দগুলোর সাথে কোরানে বর্ণিত শব্দের সম্পর্ক থাকার কথা বলেছেন আর্থার জেফারি।
সংস্কৃত ভাষার উৎস থেকে বেশ কিছু শব্দের উল্লেখ আছে যেমন, এই অঞ্চলের পালি, দ্রাবিড়, তামিল, মালায়লাম বা মুন্ডা-র ভাষার প্রসঙ্গও চোখে পড়ে। এর শুদ্ধাশুদ্ধ বিচারে ভাষাবিদরাই সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না-ভাষার সমৃদ্ধিতে আত্মীকরণ সর্বজনীন-সংস্কৃত পণ্ডিত ও আরব জাত্যাভিমানীদের নিজ নিজ ভাষা নিয়ে যে অহংকার তা একদমই অমূলক। শুদ্ধাশুদ্ধর চাইতে জরুরি বিষয়-ভাষায় বলা বোধ অনুধাবন করা।
ইসলামের প্রধান শিক্ষা- মূর্তির কোন মূল্য নাই, বোধই মূল। আম বলুক আর ম্যাঙগো বলুক দুটো শব্দই আসল ফলটির শব্দ-মূর্তি। ভাবের বিচ্যূতি না ঘটলে যে ভাষাতেই প্রকাশ করা হোক না কেন এতে কোনও বিরোধ ঘটে না। বলা হয় আল্লাহর ৯৯টি নাম-কিন্তু তা দিয়ে ৯৯টি স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্তার ধারণার বদলে বিশ্বাসীরা নিরাকার এক ইশ্বর ধারণাই প্রকাশ করেন- সৃষ্টিকর্তার ইসলামি ধারণায় এক চুল এদিক ওদিক হয় না। আরবি আরবদের মাতৃভাষা-তারা যেভাবে উচ্চারণ করতে পারে, অন্য ভাষাভাষীদের জন্য তা দুরূহ। বাঙালি আলেমের উচ্চারণেও বাংলা বাচনের কম-বেশি প্রভাব থাকেই। এতে কিছু যায় আসে না-বোধের শুদ্ধতাই প্রধান, শব্দ-মূর্তির নয়।
এই প্রেক্ষিতে যুগে যুগে নানা ভাষাভাষীর বাংলা ভাষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় কতটা সংস্কৃত মিশেছে, কতটাই বা ফারসি অথবা অন্য কোন ভাষা তা নিয়ে বিচলিত হওয়া অনাবশ্যক। শুধু অতীতে নয় প্রতিনিয়ত বাংলায় অন্য ভাষার থেকে আত্মীকরণ চলছে, চলবেও। বিশ্বাস নির্বিশেষে বাংলা ভাষা সব বাঙালির সার্বজনীন সম্পদ। বংশ পদবীতে খান, মির্জা, বেগ ইত্যাদি দেখে এখনও কেউ কেউ বহিরাগত পূর্বপুরুষের সুখ অনুভব করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সব অতীত ধুয়ে মুছে সবাই বাঙালি হয়ে গেছেন সেটাই আসল সত্য। তাই ভাষা নির্মাণে বাংলা ভাষার উৎসকেই ভিত্তি ধরে এগোতে হবে। সব ধরনের সাম্প্রদায়িক দুরভীসন্ধী পাশে ঠেলে বাংলা ভাষায় গৃহস্থালীর কাজ ছাড়াও সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দুয়ার উন্মোচনই হোক সবার লক্ষ্য।